১২ বছরের বীর বাজি রাউত

বাজি রাউত 

মাত্র ১২ বছর বয়সে বাজি রাউত যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন ব্রিটিশ ও গোড়া সৈনিকদের সামনে তার তুলনা সত্যিই হয়না। আজও তার সাহসিকতার গল্প শুনলে গা শিউরে উঠে। একটি ছোট্ট কিশোর ছেলে যখন ব্রিটিশদের পথ রুখে দাড়িয়েছে তখন দেশের তরুণ যুবকদের মনে কেন স্বাধীনতার স্ফুলিঙ্গ জেগে উঠবে না। ছেলেটি প্রতিদিন ব্রাহ্মণী নদী নৌকা বয়ে এপার ওপার করতেন, সেই নৌকাই ছিল তাদের সংসারের রোজগারের পথ। এই বাজি রাউত ওড়িশার ঢেঙ্কানল জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ভুবনে জন্মগ্রহন করেন এক দরিদ্র পরিবারে ৫ই অক্টোবর ১৯২৬ সালে। তার পিতার নাম ছিল হরি রাউত।

হরি রাউত ছিলেন পেশায় নাবিক। ছেলে এত দুষ্টু ও একগুয়ে জেদি ছিল যে, বাবার সঙ্গেই সারাদিন কেটে যায় ব্রাহ্মণী নদীতে। একগুয়ে জেদির কারনে ছেলেকে কাছ ছাড়া করতেন না বাবা। সেই দরিদ্র সংসারে নেমে এলো আরো এক বিশাল অন্ধকার। হঠাৎ করেই মৃত্যু হলো বাজির পিতা নীলকন্ঠ পুরের মাঝি হরি রাউতের। তারপর থেকেই পিতার সেই হাতের কাজ ধরলেন বাজি, সারাদিন ব্রাহ্মণী নদী পারাপার করতেন নৌকা নিয়ে। আর এদিকে বাজির মা দিনভর পড়শির বাড়িতে ঢেঁকি পারতেন। বাজিই ছিল ভাই বোনদের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ। কিন্তু সংসারের কান্ডারী হলেন বাজিই।

ওই সময় ঢেঙ্কানলের রাজা ছিলেন শঙ্করপ্রতাপ সিংহদেব। গরীব জনতার ওপর শোষন করে রোজগারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তখন ওড়িশায় রাজা ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে জনতার আক্রোশ বাড়তেই চলেছে। এগিয়ে এলেন ঢেঙ্কানলের প্রতিবাদী বৈষ্ণবচরণ পট্টনায়ক (তিনি একজন রেলকর্মী ছিলেন) ও হরমোহন পট্টনায়কের মতো বিপ্লবী। তারা শুরু করলেন "প্রজামন্দল" নামে একটি সংগঠন, "প্রজামন্দল" থেকেই শুরু করলেন তারা বানর সেনা। এই বানর সেনায় নেওয়া হয়েছিল ১০-১৫ বছরের বালকদের, তাদের কাজ ছিল ব্রিটিশদের গোপন তথ্য সংগ্রহ করা। তারপর এই বানর সেনায় যোগ দেন বাজি।

আসেপাশের রাজা ও ব্রিটিশরা মিলে রাজা শঙ্করপ্রতাপ সিংহদেবকে সাহায্যের হাত বাড়ায়। এদিকে যতই আন্দোলন বাড়ছে, ততই বেশি পাল্লা দিয়ে চলছে ব্রিটিশরা। চলছে গ্রামবাসীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার। যারা কর দিতে পারছেনা, তাদের ঘর-বাড়ি হাতির পায়ের তোলা দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কলকাতা থেকে পাঠানো হলো ২৫০ জন বন্দুকধারী সেনা। ভুবন গ্রামে চলছে তল্লাশি হরমোহন পট্টনায়কের সন্ধানে। ঘরে-ঘরে তল্লাশি চালায় ব্রিটিশ বাহিনী, চলছে অত্যাচার, জেরা করা হচ্ছে গ্রামবাসীদের। পুলিশ খবর পেয়েছে হরমোহন পট্টনায়ক ভুবন গ্রামেই লুকিয়ে আছেন।

দিনটি ছিল ১০ই অক্টোবর ১৯৩৮ সাল। সেই দিন রাতে বানর সেনার হয়ে বাজি রাউত নৌকা নিয়ে বের হন। তাদের দলের প্রতিদিন রাতে একজন করে নৌকা নিয়ে বের হতেন। সেই দিন ছিলেন বাজি রাউত কেটে গেল প্রায় রাত, পুলিশ দল ছুটে এলেন নীলকন্ঠ ঘাটে, এসে পার হয়ে ঢেঙ্কানলের যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারন ঢেঙ্কানলেই রয়েছেন বিপ্লবীরা।

রাত্রি বেলা ব্রিটিশ পুলিস বাহিনী নীলকন্ঠ ঘাটের দিকে যাত্রা করেন ব্রাহ্মণী নদী পার হয়ে ঢেঙ্কানলের দিকে যেতে হবে। পুলিস বাজির কাছে আসলো, পাশেই নৌকো ছিল। এক ব্রিটিশ পুলিস বলল ওই নৌকো দিয়ে আমাদের ওপারে পার করিয়ে দাও। বাজি চুপচাপ কিছু বলল না, যেন কিছু শুনতেই পাননি। পুলিস যখন দ্বিতীয় বার বললেন, তখন বাজি না করে দিলেন তাদের মুখের ওপর। ক্রোধে ফেটে পরলো ব্রিটিশ কর্মকর্তা, তারা বাজি রাউত কে হুকুম করলো নৌকো ছাড়ো। নদী পার করে দিতে হবে, না হলে তোকে মেরে ফেলবো। বাজি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, তবুও আমি পার করবো না। যেই হোক না কেন তিনি কোন পরিস্থিতিতে নৌকো ছাড়বেন না। বাজি রাউত জানতেন প্রজামন্দলের কর্মকর্তারা গ্রামেই আছে, এই সময় কাউকেই পার করানো যাবে না। প্রজামন্দলের কর্মকর্তারা সারা রাত পাহারা দিতে বলেছিল আমায়। এখন সময় এসেছে কর্মকর্তাদের সচিত করার। 

বাজি রাউত চিল্লাতে শুরু করলেন যাতে প্রজামন্দলের কর্মকর্তারা জেনে যায়। রেগে গিয়ে এক ব্রিটিশ পুলিস বন্দুক দিয়ে মাথায় আঘাত করলো, আর মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত ঝরছে সেই ছোট্ট বাজির। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো বাজি। কিন্তু আবার দাড়িয়ে বাজি চিল্লাতে থাকে যাতে প্রজামন্দলের কানে এই খবর পৌঁছায় যে ব্রিটিশ বাহিনী এসে গেছে। এবার আরো এক বার বন্দুক দিয়ে আঘাত করা হলো, কিন্তু তৃতীয় বার বাজি রাউতের ওপর গুলি চালানো হয়। ততক্ষনে তার চিল্লানোর শব্দ রাতের অন্ধকার চিরে কর্মকর্তাদের কানে পৌঁছে যায়। কিন্তু প্রজামন্দলের কর্মকর্তারা নীলকন্ঠ ঘাট পৌঁছনোর আগে বাজি রাউত ব্রিটিশদের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত শরীরে পরে রইলেন। ঘটনাস্থলে অনেক গ্রামবাসীও ছুটে আসে। 

দিনটি ছিল ১১ই অক্টোবর ১৯৩৮ সাল ঘনাস্থলে লোকদের ছুটে আসতে দেখে ব্রিটিশ ভয়ে থরথর করে কাপছে আর নৌকো নিয়ে নিজেরাই পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে বাজি রাউত মৃত্যুর মুখে চলে গেলো। ব্রিটিশরা নৌকো নিয়ে পালানোর সময় চারদিকে গুলি চালাতে থাকে, যার ফলে তার সঙ্গী লক্ষণ মালিক, ফাগু সাহু, রুশী প্রধান ও নাটা মালিকও মারা যান। এই ঘটনায় কেপে উঠে সারা দেশ। স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াই নতুন করে জ্বলে উঠে। বাজি রাউতকে বীরের সন্মান দেয় সারা দেশ। দেশের সর্বকনিষ্ঠ মৃত্যুঞ্জয়ী হলেন বাজি রাউত। কিন্তু আজ তাকে কজন মনে রেখেছে। আজও যখন ভোরের আলো অন্ধকার চিরে ব্রাহ্মণী নদীর পারে আলোর প্রভা ঝিকমিক করে তখন সেই আলোর প্রভা একটাই কথা বলে 'বাজি রাউত'।






Post a Comment

0 Comments