ফাঁসির মঞ্চে বীর দামাল সোহানলাল পাঠক

ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য মৃত্যুবরণ করেছিলেন, কিন্তু অনেকের কাছে আজও অজানা এই বিপ্লবী। ব্রিটিশ সরকার তার উপর সরকার বিরোধী সাহিত্য প্রকাশনা ও বিদ্রোহের পরিকল্পনা সৃষ্টি করার অপরাধে মামলা দায়ের করেন, এর ফলে তিনি অপরাধী ঘোষিত হয়। বিচারে তাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। শেষে বার্মার মান্দালয় জেলে ফাঁসির মঞ্চে উপস্থিত হন বিপ্লবী সোহানলাল পাঠক।

সোহানলালের জন্ম হয়েছিল ৭ই জানুয়ারি ১৮৮৩ সালে পাঞ্জাবের অমৃতসরে পট্টি গ্রামে। তিনি গ্রামেই মিডিল পাস করে শিক্ষক হন। একসময় মহান বিপ্লবী লালা হরদয়াল ও লালা লাজপত রায় সংস্পর্শে আসেন। তাদের অনুপ্রেরনায় তিনি একজন আদর্শ বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। তার এক বন্ধু জ্ঞান সিং শ্যামদেশে থেকেও বিপ্লবী কার্যক্রম সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই বন্ধুর অনুরোধে সোহানলাল সেখানে যান, কিন্তু কাজের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ তা জেনে তিনি সেখান থেকে আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

সেখানে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের কাছ থেকে তিনি বিপ্লবী হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন, নলিনী বাগচীও তাঁর অনুপ্রেরণা ছিলেন। নলিনী বাগচী গৃহবন্দী ছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের চোখে ধুলো ফেলে চন্দন নগরে পৌঁছেছিলেন এবং ১৯১৭ সালে ও ছদ্দবেশী বেশ ধারণ করে বিহারে গিয়ে সংগঠনটির সূচনা করেন। পুলিশ তাড়া করার পরে তিনি গৌহাটিতে যান এবং সেখানে সক্রিয় হন। কিন্তু পুলিশ তাদের এখানে ছাড়েনি এবং বিরক্ত হওয়ার পরে নলিনী বাগচীকে আরও একটি বিপ্লবীঘাঁটি খুঁজতে হয়েছিল।

দিনটি ছিল ১৫ই জুন ১৯১৮ সাল ঢাকা, বিপ্লবী তারিণী মজুমদারের বাড়িটা পুলিশ ঘেরাও করেন। গুপ্তচরের দ্বারা খবর পাওয়া যায় যে নলিনী বাগচী সেই বাড়িতেই রয়েছেন। দুই পক্ষ থেকে গুলি যুদ্ধ শুরু হয়। তারিণী মজুমদার মৃত্যুবরণ করেন। নলিনী বাগচী আহত ও পরের দিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সোহানলালকে তার বন্ধু জ্ঞান সিং একটি চিঠি লিখেছিলেন - 'আমরা জঙ্গলে গিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য শপথ করেছিলাম, ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গাওয়ার। এখন সেই সময় এসেছে।

সোহানলাল পাঠক সেদিন আমেরিকাতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি বার্মায় পৌঁছে সেনাবাহিনীতে কাজ করার আদেশ পেয়েছিলেন। সোহানলাল পাঠক আদেশ অনুসারে ব্যাংকক রুট হয়ে বার্মায় প্রবেশ করেছিলেন এবং অত্যন্ত চালাকি ও মননশীলতার সাথে তাঁর কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহ করাতে সফল হন।

একদিন সোহানলাল পাঠক গোপনে সেনাবাহিনীর সৈন্যদের দেশপ্রেমিক হতে এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মারতে ও মরতে হবে এই শিক্ষা দিচ্ছিলেন, হঠাৎ একজন ভারতীয় জামাদার তাঁর ডান হাতটি ধরে তাঁর অফিসারের কাছে উপস্থাপনের জন্য তাকে জোর করার চেষ্টা করলেন। সোহানলালের এই আশঙ্খা ছিল না। তিনি জামাদারকে যথেষ্ট ব্যাখ্যা বোঝাতে চেয়েছেন কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি।

যদিও সোহানলাল সশস্ত্র ছিলেন তবুও তিনি জামাদারের কাজ শেষ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কোন ভারতীয় ভাইকে হত্যা করা উপযুক্ত মনে করেননি। সোহানলাল অনুভব করেছিল যে একজন ভারতবাসীকে হত্যা করলে তাদের বিপ্লবী সংগঠন কলঙ্কিত হবে। তা ভেবে তিনি নিজেই গ্রেপ্তার হন এবং বিচার শুরু হয় ১৪ই ডিসেম্বর ১৯১৫ সালে। বিচারে তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। 

জেলে তিনি কখনই বন্দীদের নিয়ম কানুন অনুসরণ করেননি। তিনি বলেছিলেন যে ব্রিটিশরা যখন কোন নিয়ম কানুন অনুসরণ করে না, তবে তাদের নিয়ম কানুন কেন আমরা অনুসরণ করবো? বার্মার গভর্নর জেনারেল তাকে কারাগারে বলেছিলেন - 'আপনি ক্ষমা চাইতে পারলে ফাঁসি বাতিল হতে পারে।' তিনি জবাব দিলেন- 'অপরাধ করেছেন ইংরেজ, তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। দেশটি আমাদের আমরা তাকে মুক্তি দিতে চাই এতে অপরাধ কী? 

বার্মার জেলে ১০ই ফেব্রয়ারি ১৯১৬ সালে ফাঁসির মঞ্চে উপস্থিত হন সোহানলাল পাঠক। দেখা যায় যে ফাঁসির সময় সোহানলাল জল্লাদের হাত থেকে ফাঁসির দরি ছিনিয়ে তাঁর গলায় রাখেন। বিদায় নিলেন মহান অমর বিপ্লবী সোহানলাল পাঠক।










Post a Comment

0 Comments